বৃষ্টির ঠিকানা || মুহম্মদ জাফর ইকবাল
জাফর ইকবাল স্যারের বইগুলোতে দেশ -দেশ আর মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটা থাকবেই থাকবে। বেশ গর্ব করার মতো, তাই না? “বৃষ্টির ঠিকানা” বইটি এর ব্যতিক্রম নয় ঠিকই কিন্তু অন্য রকম এক অনুভূতি হবে তোমাদের বইটি পড়ে!
কতই না মমতা মাখানো, প্রথম যেদিন পড়েছিলাম সেদিনও আমি কেঁদেকেটে একাকার! আজও কেঁদেছি বটে, কিন্তু আরও একটি কারণে! যে আমার থেকে বইটি ধার নিয়েছিলো…সে আর কোনোদিন ধরা দেয়নি! সেও গায়েব…আমার বই-ও গায়েব। পাওয়ার আশায় আমারও আর কেনা হয়ে ওঠেনি, আমি কী খারাপ! 😥
যাহোক, পুরনো কাসুন্দি বাদ। বইয়ের কথায় আসি। মূলতঃ বইটি তেরো বছরের কিশোরী টুম্পা এবং তার স্কিটজফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বাবার মধুর এক গল্প।
টুম্পা বেড়ে উঠেছে আমেরিকায় তার মার সাথে। কিশোরী মেয়েটি ঠিকই বুঝতে পারে তার বিপিতার অনীহার দৃষ্টি। এরকম বাবা (বাবা নয়…লোক বলি) বাস্তবে একদম যে নেই তা নয়…কিন্তু এরা ভীষণ ভীরু! ভীরু বলেই নিজ পরিবার কিংবা দেশের বিরুদ্ধে যেতে এক সেকেন্ড-ও কার্পণ্য করেনা!
টুম্পা, এই এতটুকুন একটা মেয়ে, বাংলাদেশকে নিয়ে কতটা চিন্তা করলে শুধুমাত্র একটা গান থেকে যশোর রোডের সেই হৃদয়বিদারক করুণ দৃশ্য রঙ তুলির আঁচড়ে এঁকে ফেলতে পারে! যদিও ছবি আঁকা তার রক্তে! দেশ আমরা সবাই ভালোবাসি সত্যি..কিন্তু ক’জনইবা চিন্তা করি, কেন এত সুন্দর এ দেশের সবকিছু? কেন এত আত্মত্যাগ এ দেশের জন্য। টুম্পা কিন্তু ভেবেছে। তো সেই দেশ যার মননে, সে তো আর আমেরিকায় পড়ে থাকতে পারে না..তোমরা উইনিং ব্যান্ড-এর ওই গানটা শুনেছ? ঐ যে ওইটা, “প্রিয় ঠিকানা”?
‘শহর জড়ানো বৃষ্টির চাদরে
তবু ব্যস্ত মানুষ কত দিকে যায়
মনের খাতায় আজ অনেক স্মৃতি
কেমন ছিলাম আমি আজ কোথায়../পরিচিত মুখেরা প্রতিটি হৃদয়
বারবার ডাকে সেই প্রিয় ঠিকানা”♪♪♪
টুম্পার কাছে প্রিয় সেই ঠিকানা নিশ্চয়ই দূরপরদেশ আমেরিকা নয়। বৃষ্টির আকর্ষণে কিংবা দেশের টানে টুম্পা তো চলে এলো বাংলাদেশে। এরপরই কিন্তু কাহিনীর মোড় ঘুরে গেলো। কেন? কী হলো…? আগেই বলেছি বইটি এক বাবা-মেয়ের আখ্যান। তাই, কিছুটা আঁচ হয়তো করতে পারছো। কিন্তু আমি যদি বলতে থাকি এ কাহিনী জীবনেও শেষ হবে না 😅
সেদিকে আর গেলাম না তাই। বরঞ্চ বলি, কেন আমার বইটি এত্ত প্রিয়। প্রথমত, আমি বৃষ্টি খুব পছন্দ করি। বৃষ্টি এলো আর আমি মনমরা হয়ে চুপটি করে থাকব? -কক্ষনো না! Rain is like my jubilation! জাফর স্যার তো বলেই দিয়েছেন, তারাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে যাদের
“…মনে অনেক আনন্দ। ” অন্তত আমার জন্য তো অবশ্যই। এই বইটিতে স্যার কী চমৎকার ভাবেই না বৃষ্টির সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন…” এতো সুন্দর তাকে কী ভাল না বেসে পারা যায়?”
দ্বিতীয় কারণ, ক্রিস্টিনা হেনরিকসন, অসাধারণ একজন শিক্ষিকা! শিক্ষকতা, যা আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ! এমন একজন টিচার হলে আর কী কিছু লাগে বলো?
তৃতীয়ত, এই বইটি আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, ভালোবাসতে শিখিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে…শিখিয়েছে যে কোনো কিছুকে অন্য ভাবে দেখতে। এখানে বাংলাদেশের এমন এক রূপ তুলে ধরা হয়েছে, পড়ে তুমি বলবে, আমাদের অনেক ভুলত্রুটি আছে ঠিকই তবুও আমরা আর পিছিয়ে নেই এবং বিশ্বের কাছেও তা আর অজানা নয়।
টুম্পার মতো আমিও ভাবতাম আমার দেশের নাম ঠিক মতো কেন উচ্চারণ করতে পারেনা যারা অন্য ভাষায় কথা বলে! যারা ধ্বনিবিজ্ঞান/phonetics বিষয়ে অবগত আছো, তারা জানো, ইংরেজি ধ্বনিতে কিছু কিছু বাংলা ধ্বনি নেই আর গুগল কিংবা ইংরেজি অভিধানে বাংলাদেশ নামটি আছেই এভাবে
/ˌbæŋɡləˈdɛʃ/ ( ব্যাংলাডেশ)। ওরা তো বাংলা পড়তে পারে না, phonetics দেখে ওরা এভাবেই উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়।
[ বি.দ্র. গুগলে এখন / ˌbɑːŋ-/ (বাং) সংযুক্ত হয়েছে যদিও কিন্তু দ/ড এর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি ]
পরিশেষে এই বইটি আমাকে একটি অসাধারণ গান আর একটি অসাধারণ কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মৌসুমি ভৌমিকের “যশোর রোড ” আর
Allen Ginsberg’s “September on Jessore Road”! গান এবং কবিতা দুটি-ই অনেক বড়। এত্ত মন খারাপ করিয়ে দেয়.. গানের কিছু অংশ উল্লেখ করছি.. প্লিজ শুনে দেখো~
“শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দু-ধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে?
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ী-দেশ
মাথার ভিতর বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তুর
যশোর রোড যে কত কথা বলে♪”
মন খারাপ করিয়ে দিলাম, তাই না? কিন্তু “বৃষ্টির ঠিকানা” পড়ে মন ভালো হতে বাধ্য! তাই দেরি করো না, ঠিক আছে? পড়ে ফেলো শীঘ্রই।
Happy Reading~ ❤